সমস্ত লেখাগুলি

সংবিধান, ধর্মীয় অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে -
ঈশান দে
Nov. 19, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:880 | likes:1 | share: 1 | comments:0

ভারতবর্ষের সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে চালু হয়। বাবাসাহেব ডঃ বি.আর.আম্বেদকর সংবিধান কিন্তু একা

লেখেননি। সর্বপ্রথমে উনি বেশ কয়েকটি দেশবিদেশের সংবিধান গ্রন্থ ও আইনি বইপত্র ভালো করে পড়ে তারপরে সেখান থেকে নির্যাস নিয়ে, দীর্ঘ আলোচনার পরে ২৯৯ জনের মিলিত মতামতে জন্ম সংবিধানের। 


সময়ের সাথে যেমন বিভিন্ন বইপত্র সংশোধন, পরিবর্ধন এবং পরিমার্জনের প্রয়োজন হয় তেমনই ভারতীয় সংবিধানও হয়েছে। ১১ আগষ্ট ২০২১ এ পার্লামেন্ট পাশ হয়েছে ১২৭ তম সংবিধান সংশোধনী বিল। এতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ মহাশয় স্বাক্ষর করায় সেটি পরিণত হয়েছে ১০৫ তম সংবিধান সংশোধনী আইনে। প্রসঙ্গত জানাই, এই সংশোধনীর ফলে রাজ্যগুলি নিজেরাই নিজস্ব ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর তালিকা প্রস্তুত করবে এবং তার জন্য ন্যাশনাল কমিশন ফর ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের অনুমতি লাগবে না। এর জন্য ভারতীয় সংবিধানের ৩৪২-এ এবং ৩৪২ এ (৩) ধারা সংশোধন করা হয়েছে। 


সংবিধানের শুরুতে সেখানে 'ধর্মনিরপেক্ষ' বা 'Secular' শব্দটি ছিল না। মাননীয়া ইন্দিরা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৭৬ সালে ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত রাষ্ট্রপতির ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে 'সমাজতান্ত্রিক' এবং 'ধর্মনিরপেক্ষ' (কোনোরকম সংজ্ঞা ছাড়াই) শব্দদুটি যুক্ত করা হয়। মুখবন্ধের (Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষ' (Secular) শব্দটি ব্যবহার করার পরে যেখানে লেখা হয়েছে -" We The People Of India, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens;"(অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি)।


ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় খন্ডে, দেশের নাগরিকদের ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার দেওয়া দিয়েছে (সংবিধানের ১৪-৩৫ নং ধারা)। যেমন - (১) সাম্যের অধিকার (২) স্বাধীনতার অধিকার (৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (৪) ধর্মীয় অধিকার, (৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার, এবং (৬) শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার। 


ধর্মনিরপেক্ষতা' বা 'Secularism' শব্দটা নিয়ে আমজনতার মধ্যেই রয়েছে প্রচুর বিভ্রান্তি, সঙ্গে তথ্যবিকৃতিও করা হয়েছে বিশেষ উদ্দ্যেশ্যে। ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির উৎপত্তি ইউরোপে। 'Secularism' এর আভিধানিক অর্থ - "An ism does not related with religion and non entity to any supernatural existence"। অর্থাৎ ধর্মের সঙ্গে কোনও রূপ সম্পর্কিত নয় এমন একটি মতবাদ হল ধর্মনিরপেক্ষতা। নিরপেক্ষ শব্দের অর্থ কোনও অথবা কারোর পক্ষেই নয় থাকা নয়। তাই ধর্মনিরপেক্ষ মানে মোটেই সর্বধর্মসমন্বয় নয়, এর অর্থ 'রাষ্ট্র' ('রাষ্ট্র' অর্থে এখানে একটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে বোঝানো হয়েছে। যেমন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, সাংসদ বিধায়ক, সরকারি আমলা থেকে পাড়ার কাউন্সিলর ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে) কোনও  ধর্মের পক্ষেই থাকবে না, সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই থাকবে নিরপেক্ষ বা সম্পর্ক বর্জিত। ঠিক যেমনটা একজন রেফারী ইষ্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের মধ্যে ফুটবল খেলায় অথবা ভারত বনাম পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট খেলায় আম্পেয়ার নিরপেক্ষ থেকে খেলা পরিচালনা করেন। 


নির্বাচনে দাঁড়ানো ডান-বাম-ওপর-নীচ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো উক্ত প্রস্তাবনাকে সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকারে "The Representation of the People Act 1951" (Amendment 1989) এর 29(A) ধারায় দায়বদ্ধ। অবশ্য, কার্যক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের "ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়" এর অবস্থা হতে পারে। এমনকি নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে অনেক। আইনের প্রয়োগ এবং সদিচ্ছার অভাবে ভারতে গোদীলোভী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থেই ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচার করে, তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছে অনেক আগেই।


এইখানে একটি বিশেষ খবর জানিয়ে রাখা উচিত হবে যে, গত ৩ রা জানুয়ারি ২০১৭ তে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় ও ভাষার ভিত্তিতে ভোট চাওয়া বা ভোট না দিতে প্ররোচিত করাকে দুর্নীতিপূর্ণ আচরণ বলেই রায় দিয়েছিল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চে চার জন বিচারপতি এ ব্যাপারে জানিয়েছেন, কেবল প্রার্থী নয়, ভোটারদের ধর্ম-বর্ণের ধুয়ো তুলেও ভোটের প্রচার করা যাবে না। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২৩(৩) ধারায় ধর্ম, জাতি, ভাষা, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া অবশ্য এমনিতেই নিষিদ্ধ। শীর্ষ আদালত বলেছে— কেবল প্রার্থী নয়, প্রচারে আনা যাবে না ভোটারদের ধর্ম, জাতি, ভাষার কথাও। এমনকী প্রার্থীর এজেন্টের সামাজিক পরিচয়ের জোরেও ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যাবে না। এখন প্রশ্ন এটাই, শীর্ষ আদালতের এই রায় কার্যকর করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেক রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, ধর্ম- জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট চাইলে প্রার্থী পদ বাতিল করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। তারা বড়জোর আদালতে যেতে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে কড়া পদক্ষেপ করতে হলে আইন করে কমিশনকে আরও ক্ষমতা দিতে হবে। কিন্তু তা করতে ভয় পায় সব দলই। কারণ ধর্ম, জাতপাতের অঙ্ককে অস্বীকার করার ক্ষমতা তাদের নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে ধর্মীয় মেরুকরণ এবং অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্রর ঝাঁঝালো বক্তব্য রেখেই কিন্ত ২০১৩ সালে একটি রাজনৈতিক দল ভারতে কেন্দ্র সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল।


ভারতীয় সংবিধানে ২৫ থেকে ২৮ নং ধারায় আমজনতার ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি রয়েছে, যা আবেগের নয় বরং যুক্তিপূর্ণ আলোচনার বিষয়। ভারতীয় সংবিধান আমজনতাকে দিয়েছে ধর্মপালন বা ধর্মাচারণ করার স্বাধীনতা, কিন্তু সেটা কখনওই প্রকাশ্যে নয় বরং একান্তে, ব্যাক্তিগত ভাবে। অন্যদিকে, ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্যের কথাও সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। যেমন, প্রতি ভারতীয় নাগরিকের কর্তব্য হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতা, মনুষ্যত্ব এবং অনুসন্ধিৎসা ও সংস্কার সাধনের মানসিকতার বিকাশ ঘটানো। "It shall duty of every citizen of India to develop the scientific temper humanism and the spirit of inquiry and reform.{Article 51A(h)Part iv A}"।


ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় অধিকার বা ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আমজনতার মধ্যে রয়ে গেছে নানানরকম বিভ্রান্তি। অন্যদিকে বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মীদের উচিৎ খুব ঠান্ডা মাথায় ভারতীয় সংবিধান এবং ভারতীয় আইনের বইপত্র ভালো করে পড়ে দেখা। আমাদের সংবিধানে এমন বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো পরস্পরবিরোধী যার সংশোধনের প্রয়োজন আবশ্যক। আবার এমনও কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো যথেষ্ট চিন্তার খোরাক যোগাতে বাধ্য। 


যেমন -১) সংবিধানে বর্ণিত একটি Secular, Democratic, Republic Country ভারতে লাগু রয়েছে শরীয়া আইন (The Muslim Personal Law (Sharia) Application Act,1937)। ভারতে এটি শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মূলতঃ বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক, অভিভাবকত্ত্ব এর মত বিষয়গুলি শরিয়া আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ক্ষেত্রে এখানে শরীয়া আইন কার্যকরী নয়। মূলতঃ এই আইন দ্বারা ভারতীয় মুসলিম মহিলারা নিষ্পেষিত ও শোষিত।


২) ব্লাসফেমি অ্যাক্ট। কোনও বিশেষ ধর্মের বিষয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করাকে 'ব্লাসফেমি' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের 'Commission on International Religious Freedom' এর ২০১৭ সালের রিপোর্টে ৭১ টি দেশের তালিকা উঠে আসে যেখানে ব্লাসফেমি আইন রয়েছে। এই আইনের অধীনে কোনও  কোনও  ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। 


বহু কিছুর মধ্যে একটা মর্মান্তিক শোনা যাক। সম্ভবত আগষ্ট ২০২১ এর ঘটনা, ধর্ম অবমাননার দায়ে পাকিস্তানে আটক একটি হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী পরিবারের ৮ বছরের ছেলে মৃত্যদন্ডে দণ্ডিত। যে বয়সের শিশুরা জানেই না ধর্ম নামক জিনিসটা খায়, নাকি মাথায় মাখে? সেই বয়সের একটি শিশু কীভাবে ধর্ম অবমাননা করতে পারে? সে কীভাবেই বা অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করতে পারে? 


দন্ডবিধি ১৮৬০, অনুচ্ছেদ ১৫র ২৯৫ ধারা থেকে ২৯৮ ধারা (IPC-295-298) পর্যন্ত সংশোধন করা প্রয়োজন এবং এর মধ্যে ২৯৫-ক (IPC-295A) ধারাটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা খুবই প্রয়োজন। সংবিধান প্রতিশ্রুত নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী এই আইন। আলোচনা, সমালোচনা, মতপ্রকাশ এবং উস্কানি, বিদ্বেষ, ঘৃণাবাদ এক নয় অন্যদিকে, দন্ডবিধি-১৮৬০ এর পঞ্চদশ অধ্যায়ের ২৯৫-ক ধারাটিতে আলোচনা, সমালোচনা, বাক্ স্বাধীনতা তথা মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করা হয়েছে।


৩) ভারতীয় সংবিধানের ২৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে যে, 'No religious instruction shall be provided in any educational institution wholly maintained out of State funds.' অর্থাৎ, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনওরকম ধর্মীয় নির্দেশ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা যাবে না। আবার, ২৮ (২) নং ধারায় লেখা হয়েছে- 'Nothing in clause 28(1) shall apply to an educational institution which is administered by the State but has been established under any endowment or trust which requires that religious instruction shall be imparted in such institution.' ফলে কনভেন্ট স্কুল বা মিশনারি স্কুল কিংবা বৈদিক বিদ্যালয় অথবা মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এই স্ববিরোধীতা সংশোধনের বিশেষ প্রয়োজন।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929